‘অনন্য’ সাঙ্গাকারার গল্প
আরিফুর রহমান বাবু
আশির দশকের শেষ দিকের কথা। ক্যান্ডির পাহাড় ঘেঁষেই থাকতেন স্বর্ণ কুমারা সাঙ্গাকারা। পেশায় উকিল। তাই দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামতেই বাড়িতে একের পর এক মক্কেল এসে হাজির হতেন। কিন্তু যার কাছে আইনি আশ্রয়ের আশায় ছুটে আসা সেই স্বর্ণ কুমারা সাঙ্গাকারার দেখা মিলতো না সহজে। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে এক সময় ধৈর্যচ্যুতি ঘটতো। কেউ কেউ চেঁচামেচি শুরু করে দিতেনÑ কী হলো! যার কাছে এলাম সেই উকিল সাহেব কোথায়? তার তো টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। তিনি কি আসলে বাড়িতে নেই? না থাকলে থাকলে বলে দিন। খামোখা আমাদের বসিয়ে রেখে কি লাভ? আরেকটু অপেক্ষা করুন। উকিল সাহেব এখনই এসে পড়বেন। এসব বলে মক্কেলদের বসিয়ে রাখতেন স্ত্রী। স্বর্ণ কুমারা। কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেতো তারও। স্বর্ণ কুমারা সাঙ্গাকারা বাড়ি ফিরতেই কৈফিয়ত- কী ব্যাপার, এতো দেরি করলে যে? মানুষজন তোমার অপেক্ষায় বসে আছে আর তুমি নিরুদ্দেশ!
স্বর্ণ কুমারা রেগে-মেগে জবাব দিতেন- থাকগে, এতে আমার কী? জানো না, এই সময়টায় একটা বিশেষ কাজে ব্যস্ত থাকি? তারা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে ঠিক কিন্তু আমিও আমার ছেলের সঙ্গে কাজে ব্যস্ত ছিলাম। ছেলের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসি কী করে? শুনবেন, ক্যান্ডির সেই উকিল স্বর্ণ কুমারা সাঙ্গাকারা কে? আজকের বিশ্ব বরেণ্য ক্রিকেটার কুমারা সাঙ্গাকারার পিতা।
ওই আইনজীবীর বাসায় যখন মক্কেলরা অপেক্ষার প্রহর গুনতেন, তিনি তখন ছেলেকে টেনিস বল ছুড়ে ব্যাটিং প্র্যাকটিস করাতেন।
যার জন্য পিতার হাড়ভাঙা খাটুনি সেই কিশোর তখনো স্কুলের ছাত্র। বড় বোন সারাঙ্গা টেনিসে শ্রীলংকার জাতীয় চ্যাম্পিয়নও ছিলেন। কিশোর বয়সে একদিন বোনের কাছে হেরেই টেনিসের প্রতি উৎসাহ কমে যাওয়া। এরপর ক্রিকেটে মনোযোগী হওয়া। আর হাতেখড়ি পিতার কাছেই। আশির দশকের ওই কিশোরই এখন লংকান ক্রিকেটের রাজকুমার কুমারা সাঙ্গাকারা। তিনি শ্রীলংকার সব সময়ের সেরা ব্যাটসম্যান কি না তা নিয়ে ছোটখাটো একটি বিতর্ক হতেই পারে। কারণ দুই শব্দে গড়া হলেও ‘সেরা’র ব্যাপ্তি বিশাল। লংকান ক্রিকেটে বেশ কয়েকজন বিশ্বমানের উইলোবাজের জন্ম হয়েছে। সংখ্যাটা একদম ছোট নয়। রয় ডায়াস, অনুরা টেনেকুন, বান্দুলা ওয়ার্নাপুরা, অরবিন্দ ডি সিলভা, সনথ জয়সুরিয়া, মারভান আত্তাপাতু, মাহেলা জয়বর্ধনে, কুমারা সাঙ্গাকারাসহ অনেক নাম। তারা বিভিন্ন সময় নিজের মেধা, মনন ও অধ্যবসায় দিয়ে ক্রিকেট মাঠ করেছেন আলোকিত। তবে সবার ব্যাটিংশৈলী এক রকম ছিল না। কেউ একটু বেশি নান্দনিক ঢঙে খেলতেন, কারো ব্যাটিংয়ে শৈল্পিকতা বেশি ছিল। ওই দলে রয় ডায়াস, অরবিন্দ ডি সিলভা ও মারভান আত্তাপাত্তু আছেন।
কেউ বা আবার শৈল্পিকতা ও নান্দনিকতার ধার না ধেরে তেড়ে-ফুঁড়ে ব্যাট চালাতেই বেশি পছন্দ করতেন। বলের মেধা ও গুণ বিচার করে খেলার বদলে প্রতিপক্ষ বোলিংকে দুমড়ে-মুচড়ে দিতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, অমন দলের সদস্য ছিলেন সনথ জয়সুরিয়া। এর বাইরে আরও দুই লংকান ব্যাটসম্যান গত এক যুগ ক্রিকেট মাঠে আলো ছড়িয়েছেন। তাদের ব্যাটিং দেখে মুগ্ধ ক্রিকেট বিশ্ব।
কাকতালীয়ভাবে তারা আবার খুব ভালো বন্ধু- মাহেলা জয়বর্ধনে আর কুমারা সাঙ্গাকারা। অল্প সময়ের ব্যবধানে টেস্ট ক্রিকেট কে বিদায় জানিয়েছেন দু’বন্ধু। দু’জনার ব্যাটিং টেকনিক, শৈলী ও ব্যাটচালনার ধরনও প্রায় এক। পরিপাটি ব্যাটিংশৈলী, তাড়াহুড়া না করে পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে থিতু হয়ে ধীরে ধীরে ইনিংস সাজানো, দীর্ঘ সময় উইকেটে কাটিয়ে লম্বা ইনিংস গড়ায় দু’বন্ধুই প্রায় সমান পারদর্শী। কৃতিত্ব, অর্জন, প্রাপ্তি- যাই বলা হোক না কেন, দু’জন প্রায় কাছাকাছি। তবে রান করায় বন্ধু মাহেলাকে পেছনে ফেলে দিয়েছেন কুমারা সাঙ্গাকারা।
ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে অতো উজ্জ্বল মনে হয়নি। কিন্তু সোনা পুড়ে পুড়ে খাঁটি হয়, কুমারা সাঙ্গাকারার ব্যাটও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ততো উজ্জ্বল হয়েছে। এক সময় তার হাতের ওই উইলোটা রূপান্তরিত হয় ‘রানমেশিন’-এ। কোনো ব্যাটসম্যানের পক্ষে যতো ভালো খেলা যায়, বড় বড় ইনিংস সাজিয়ে ইতিহাস গড়া সম্ভবÑ কুমারা সাঙ্গাকারা ঠিক তা-ই করেছেন। তাই তো টেস্ট, ওয়ানডে আর টি২০ ক্রিকেটের সব ফরম্যাটে শচিন টেন্ডুলকারের পর দ্বিতীয় সর্বাধিক রান কুমারা সাঙ্গাকারার। তিন ফরম্যাটে শচিনের সংগ্রহ ৩৪ হাজার ৩৫৭ আর কুমারা সাঙ্গাকারার ২৮ হাজার ১৬ রান।
টেস্ট ক্রিকেটে সব সময়ের বেশি রান সংগ্রহকারীর তালিকায় পাঁচ নম্বর জায়গাটিও এ লংকান বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের (১২ হাজার ৪০০)। তার উপরে আছেন মাত্র চারজনÑ শচিন টেন্ডুলকার (১৫ হাজার ৯২১), রিকি পন্টিং (১৩ হাজার ৩৭৮), জ্যাক ক্যালিস (১৩ হাজার ২৮৯) ও রাহুল দ্রাবিড় (১৩ হাজার ২৮৮)। তবে দুটি অর্জন ও কৃতিত্বে সাঙ্গাকারার পেছনে তারা। প্রথমত. তাদের কারোই ট্রিপল সেঞ্চুরি নেই। কিন্তু সাঙ্গাকারা ঠিক ট্রিপল সেঞ্চুরির মালিক। এছাড়া ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকানোর কৃতিত্বেও তিনি অনেকের আগে। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের (১২টি) পর টেস্টে তার ডাবল সেঞ্চুরিই সবচেয়ে বেশি (১১টি)।
একদিনের ক্রিকেটেও সাঙ্গাকারা কম যাননি। শচিনের (১৮ হাজার ৪২৬ ) পর তার ১৪ হাজার ২৩৪ রানই সবচেয়ে বেশি।
শুধু ব্যাটসম্যান কুমারার কথা বলা কেন, কিপার সাঙ্গাকারার কৃতিত্বও কম নয়, অনেক বড়। ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি শিকার তার। বিশ্বকাপেও উইকেটের পেছনে তার শিকার সর্বাধিক।
মাঠের এ অনন্য প্রতিভাবান ক্রিকেটার সাঙ্গাকারা মাঠের বাইরেও অসাধারণ। তার জীবনবোধ, দর্শন ও চিন্তা-চেতনাও দারুণ। খেলার পাশাপাশি পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আইনেøাতক সাঙ্গাকারা কথা বলায় আরও দক্ষ। ২০০৯ সালে ইংল্যান্ডের মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি)-এ তার অসাধারণ বক্তব্যের কথা এখনো অনেকের মুখে মুখে। প্রসিদ্ধ ইংলিশ ক্রিকেট লিখিয়ে পিটার রোবকের চোখে এটিই কোনো ক্রিকেটারের সেরা বক্তব্য।
এমন আকাশছোঁয়া অর্জন আর প্রাপ্তির পরও একটা আক্ষেপ আছে। আরেক লংকান গ্রেট অরবিন্দ ডি সিলভার মতো ফাইনালে সেঞ্চুরি করে বিশ্বকাপ জেতানো হয়নি। সেটি অধরাই থেকে গেছে। দু’দুইবার বিশ্বকাপের ফাইনালে গিয়েও তা ছোঁয়া হয়নি। ওই না পারার দুঃখটা খানিক লাঘব হয়েছে ২০১৪ সালে বিশ্ব টি২০-তে।
একদিনের বিশ্বকাপ জেতাতে না পারলেও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মিরপুরের শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ভারতের বিরুদ্ধে বিশ্ব টি২০-এর ফাইনালে অনবদ্য ব্যাটিংয়ে ম্যাচসেরা হন সাঙ্গাকারা। শুধু তা নয়, ওই আসরের শিরোপাও জেতে শ্রীলংকা।
অরবিন্দ ডি সিলভার পর কুমারা সাঙ্গাকারাও বনে যান লংকান জাতীয় বীর।