‘অনন্য’ সাঙ্গাকারার গল্প
আরিফুর রহমান বাবু
আশির দশকের শেষ দিকের কথা। ক্যান্ডির পাহাড় ঘেঁষেই থাকতেন স্বর্ণ কুমারা সাঙ্গাকারা। পেশায় উকিল। তাই দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামতেই বাড়িতে একের পর এক মক্কেল এসে হাজির হতেন। কিন্তু যার কাছে আইনি আশ্রয়ের আশায় ছুটে আসা সেই স্বর্ণ কুমারা সাঙ্গাকারার দেখা মিলতো না সহজে। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে এক সময় ধৈর্যচ্যুতি ঘটতো। কেউ কেউ চেঁচামেচি শুরু করে দিতেনÑ কী হলো! যার কাছে এলাম সেই উকিল সাহেব কোথায়? তার তো টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। তিনি কি আসলে বাড়িতে নেই? না থাকলে থাকলে বলে দিন। খামোখা আমাদের বসিয়ে রেখে কি লাভ? আরেকটু অপেক্ষা করুন। উকিল সাহেব এখনই এসে পড়বেন। এসব বলে মক্কেলদের বসিয়ে রাখতেন স্ত্রী। স্বর্ণ কুমারা। কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেতো তারও। স্বর্ণ কুমারা সাঙ্গাকারা বাড়ি ফিরতেই কৈফিয়ত- কী ব্যাপার, এতো দেরি করলে যে? মানুষজন তোমার অপেক্ষায় বসে আছে আর তুমি নিরুদ্দেশ!
স্বর্ণ কুমারা রেগে-মেগে জবাব দিতেন- থাকগে, এতে আমার কী? জানো না, এই সময়টায় একটা বিশেষ কাজে ব্যস্ত থাকি? তারা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে ঠিক কিন্তু আমিও আমার ছেলের সঙ্গে কাজে ব্যস্ত ছিলাম। ছেলের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসি কী করে? শুনবেন, ক্যান্ডির সেই উকিল স্বর্ণ কুমারা সাঙ্গাকারা কে? আজকের বিশ্ব বরেণ্য ক্রিকেটার কুমারা সাঙ্গাকারার পিতা।
ওই আইনজীবীর বাসায় যখন মক্কেলরা অপেক্ষার প্রহর গুনতেন, তিনি তখন ছেলেকে টেনিস বল ছুড়ে ব্যাটিং প্র্যাকটিস করাতেন।
যার জন্য পিতার হাড়ভাঙা খাটুনি সেই কিশোর তখনো স্কুলের ছাত্র। বড় বোন সারাঙ্গা টেনিসে শ্রীলংকার জাতীয় চ্যাম্পিয়নও ছিলেন। কিশোর বয়সে একদিন বোনের কাছে হেরেই টেনিসের প্রতি উৎসাহ কমে যাওয়া। এরপর ক্রিকেটে মনোযোগী হওয়া। আর হাতেখড়ি পিতার কাছেই। আশির দশকের ওই কিশোরই এখন লংকান ক্রিকেটের রাজকুমার কুমারা সাঙ্গাকারা। তিনি শ্রীলংকার সব সময়ের সেরা ব্যাটসম্যান কি না তা নিয়ে ছোটখাটো একটি বিতর্ক হতেই পারে। কারণ দুই শব্দে গড়া হলেও ‘সেরা’র ব্যাপ্তি বিশাল। লংকান ক্রিকেটে বেশ কয়েকজন বিশ্বমানের উইলোবাজের জন্ম হয়েছে। সংখ্যাটা একদম ছোট নয়। রয় ডায়াস, অনুরা টেনেকুন, বান্দুলা ওয়ার্নাপুরা, অরবিন্দ ডি সিলভা, সনথ জয়সুরিয়া, মারভান আত্তাপাতু, মাহেলা জয়বর্ধনে, কুমারা সাঙ্গাকারাসহ অনেক নাম। তারা বিভিন্ন সময় নিজের মেধা, মনন ও অধ্যবসায় দিয়ে ক্রিকেট মাঠ করেছেন আলোকিত। তবে সবার ব্যাটিংশৈলী এক রকম ছিল না। কেউ একটু বেশি নান্দনিক ঢঙে খেলতেন, কারো ব্যাটিংয়ে শৈল্পিকতা বেশি ছিল। ওই দলে রয় ডায়াস, অরবিন্দ ডি সিলভা ও মারভান আত্তাপাত্তু আছেন।
কেউ বা আবার শৈল্পিকতা ও নান্দনিকতার ধার না ধেরে তেড়ে-ফুঁড়ে ব্যাট চালাতেই বেশি পছন্দ করতেন। বলের মেধা ও গুণ বিচার করে খেলার বদলে প্রতিপক্ষ বোলিংকে দুমড়ে-মুচড়ে দিতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, অমন দলের সদস্য ছিলেন সনথ জয়সুরিয়া। এর বাইরে আরও দুই লংকান ব্যাটসম্যান গত এক যুগ ক্রিকেট মাঠে আলো ছড়িয়েছেন। তাদের ব্যাটিং দেখে মুগ্ধ ক্রিকেট বিশ্ব।
কাকতালীয়ভাবে তারা আবার খুব ভালো বন্ধু- মাহেলা জয়বর্ধনে আর কুমারা সাঙ্গাকারা। অল্প সময়ের ব্যবধানে টেস্ট ক্রিকেট কে বিদায় জানিয়েছেন দু’বন্ধু। দু’জনার ব্যাটিং টেকনিক, শৈলী ও ব্যাটচালনার ধরনও প্রায় এক। পরিপাটি ব্যাটিংশৈলী, তাড়াহুড়া না করে পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে থিতু হয়ে ধীরে ধীরে ইনিংস সাজানো, দীর্ঘ সময় উইকেটে কাটিয়ে লম্বা ইনিংস গড়ায় দু’বন্ধুই প্রায় সমান পারদর্শী। কৃতিত্ব, অর্জন, প্রাপ্তি- যাই বলা হোক না কেন, দু’জন প্রায় কাছাকাছি। তবে রান করায় বন্ধু মাহেলাকে পেছনে ফেলে দিয়েছেন কুমারা সাঙ্গাকারা।
ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে অতো উজ্জ্বল মনে হয়নি। কিন্তু সোনা পুড়ে পুড়ে খাঁটি হয়, কুমারা সাঙ্গাকারার ব্যাটও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ততো উজ্জ্বল হয়েছে। এক সময় তার হাতের ওই উইলোটা রূপান্তরিত হয় ‘রানমেশিন’-এ। কোনো ব্যাটসম্যানের পক্ষে যতো ভালো খেলা যায়, বড় বড় ইনিংস সাজিয়ে ইতিহাস গড়া সম্ভবÑ কুমারা সাঙ্গাকারা ঠিক তা-ই করেছেন। তাই তো টেস্ট, ওয়ানডে আর টি২০ ক্রিকেটের সব ফরম্যাটে শচিন টেন্ডুলকারের পর দ্বিতীয় সর্বাধিক রান কুমারা সাঙ্গাকারার। তিন ফরম্যাটে শচিনের সংগ্রহ ৩৪ হাজার ৩৫৭ আর কুমারা সাঙ্গাকারার ২৮ হাজার ১৬ রান।
টেস্ট ক্রিকেটে সব সময়ের বেশি রান সংগ্রহকারীর তালিকায় পাঁচ নম্বর জায়গাটিও এ লংকান বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের (১২ হাজার ৪০০)। তার উপরে আছেন মাত্র চারজনÑ শচিন টেন্ডুলকার (১৫ হাজার ৯২১), রিকি পন্টিং (১৩ হাজার ৩৭৮), জ্যাক ক্যালিস (১৩ হাজার ২৮৯) ও রাহুল দ্রাবিড় (১৩ হাজার ২৮৮)। তবে দুটি অর্জন ও কৃতিত্বে সাঙ্গাকারার পেছনে তারা। প্রথমত. তাদের কারোই ট্রিপল সেঞ্চুরি নেই। কিন্তু সাঙ্গাকারা ঠিক ট্রিপল সেঞ্চুরির মালিক। এছাড়া ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকানোর কৃতিত্বেও তিনি অনেকের আগে। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের (১২টি) পর টেস্টে তার ডাবল সেঞ্চুরিই সবচেয়ে বেশি (১১টি)।
একদিনের ক্রিকেটেও সাঙ্গাকারা কম যাননি। শচিনের (১৮ হাজার ৪২৬ ) পর তার ১৪ হাজার ২৩৪ রানই সবচেয়ে বেশি।
শুধু ব্যাটসম্যান কুমারার কথা বলা কেন, কিপার সাঙ্গাকারার কৃতিত্বও কম নয়, অনেক বড়। ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি শিকার তার। বিশ্বকাপেও উইকেটের পেছনে তার শিকার সর্বাধিক।
মাঠের এ অনন্য প্রতিভাবান ক্রিকেটার সাঙ্গাকারা মাঠের বাইরেও অসাধারণ। তার জীবনবোধ, দর্শন ও চিন্তা-চেতনাও দারুণ। খেলার পাশাপাশি পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আইনেøাতক সাঙ্গাকারা কথা বলায় আরও দক্ষ। ২০০৯ সালে ইংল্যান্ডের মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি)-এ তার অসাধারণ বক্তব্যের কথা এখনো অনেকের মুখে মুখে। প্রসিদ্ধ ইংলিশ ক্রিকেট লিখিয়ে পিটার রোবকের চোখে এটিই কোনো ক্রিকেটারের সেরা বক্তব্য।
এমন আকাশছোঁয়া অর্জন আর প্রাপ্তির পরও একটা আক্ষেপ আছে। আরেক লংকান গ্রেট অরবিন্দ ডি সিলভার মতো ফাইনালে সেঞ্চুরি করে বিশ্বকাপ জেতানো হয়নি। সেটি অধরাই থেকে গেছে। দু’দুইবার বিশ্বকাপের ফাইনালে গিয়েও তা ছোঁয়া হয়নি। ওই না পারার দুঃখটা খানিক লাঘব হয়েছে ২০১৪ সালে বিশ্ব টি২০-তে।
একদিনের বিশ্বকাপ জেতাতে না পারলেও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মিরপুরের শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ভারতের বিরুদ্ধে বিশ্ব টি২০-এর ফাইনালে অনবদ্য ব্যাটিংয়ে ম্যাচসেরা হন সাঙ্গাকারা। শুধু তা নয়, ওই আসরের শিরোপাও জেতে শ্রীলংকা।
অরবিন্দ ডি সিলভার পর কুমারা সাঙ্গাকারাও বনে যান লংকান জাতীয় বীর।
একটি টেস্ট ম্যাচ একটি ইতিহাস এবং কিংবদন্তী হানিফ মোহাম্মদ
- ঋভু অনিকেত
কথিত আছে, বারবাডোস-এর ব্রিজটাউন টেস্টের সময় এক কিশোর স্টেডিয়ামের বাইরে একটি গাছের ওপর বসে খেলা দেখছিল। তখন হানিফ মোহাম্মদ ব্যাট করছিলেন। অসাবধানতাবশত ওই কিশোর গাছ থেকে পড়ে গিয়ে এমন আঘাত পেয়েছিল যে, সে দু’দিন অজ্ঞান ছিল। দু’দিন পর আবার খেলা দেখতে এসে দেখে তখনো হানিফ মোহাম্মদ ব্যাট করছেন!
সেদিনটি ছিল ১৯৫৮ সালের ২৩ জানুয়ারি। ৯৭০ মিনিট ব্যাট করে ক্রিকেটের এক মহাকাব্য রচনা করেছিলেন হানিফ মোহাম্মদ। ওই রেকর্ড এখন পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারেননি। আর পারবেন বলে মনেও হয় না। দীর্ঘদিন ক্যানসারে ভুগে গত ১১ আগস্ট ৮১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ওই কিংবদন্তি ক্রিকেটার।
হানিফ মোহাম্মদ ১৯৩৪ সালের ২১ ডিসেম্বর অবিভক্ত ভারতের গুজরাটের জুনাগড়ে জন্মগ্রহণ করেন। ভারতীয় ক্রিকেটার সেলিম দুররানি-র বাবা আফগান ক্রিকেটার আবদুল আজিজ দুররানির কাছে তার ক্রিকেটের প্রশিক্ষণ শুরু। পাকিস্তানের পক্ষে ১৯৫২-৫৩ ও ১৯৬৯-৭০ সালে ৫৮টি টেস্ট ম্যাচ খেলেন তিনি। তার ব্যাটিং গড় ছিল ৪৩ দশমিক ৯৮-এর মধ্যে ১২টি শতক ছিল। তার চার ভাই-ই ক্রিকেটার ছিলেন। তাদের মধ্যে মোস্তাক মোহাম্মদ, সাদিক মোহাম্মদ ও ওয়াজির মোহাম্মদ পাকিস্তান জাতীয় দলের ক্রিকেটার ছিলেন। ছোট ভাই রাইস মোহাম্মদ একবার শুধু দ্বাদশ ব্যক্তি হিসেবে দলে সুযোগ পেয়েছিলেন। হানিফ মোহাম্মদের ছেলে শোয়েব মোহাম্মদও পাকিস্তান দলের ক্রিকেটার ছিলেন। ক্রিকেটার হিসেবে অবসর নেয়ার পর তিনি প্রায় দু’দশক ধরে ক্রীড়া বিষয়ের ম্যাগাজিন ‘দি ক্রিকেটার’ (ঞযব ঈৎরপশবঃবৎ) সম্পাদনাও করেছেন।
এবার আসি ওই ঐতিহাসিক টেস্ট ম্যাচের কথায়। ১৯৫৮ সালের ১৭ জানুয়ারি বারবাডোসের ব্রিজটাউন-এর কেনসিংটন ওভাল স্টেডিয়ামে টেস্ট ম্যাচটি শুরু হয়। টসে জিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখন বিশ্বের অন্যতম পরাক্রমশালী ক্রিকেট দল। কনরাড হান্ট, রোহান কানহাই, এভারটন উইকস ও গ্যারি সোবার্স-এর মতো বাঘা ক্রিকেটারদের প্রতাপ তখন বিশ্ব ক্রিকেটে। কনরাড হান্ট-এর ১৪২ আর এভারটন উইকস-এর ১৯৭ রানের ওপর ভর করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম ইনিংসে ৯ উইকেটে ৫৭৯ রান করে ডিক্লেয়ার করে। টেস্ট ক্রিকেটে মাত্র ছয় বছরের অভিজ্ঞতা পাকিস্তানের। আবার বারবাডোসের প্রচ- গরমে দু’দিন ধরে ফিল্ডিং করে ক্লান্ত পাকিস্তান দল। জবাবে পাকিস্তান ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুর্ধর্ষ বোলিংয়ের তোপে টিকতে না পেরে প্রথম ইনিংসে মাত্র ৪২ দশমিক ২ ওভার খেলে ১০৬ রান করে ফলো অনে বাধ্য হয়। ওই সময় টেস্ট ক্রিকেট ছয় দিনের ছিল। একদিকে ৪৭৩ রানে পিছিয়ে থাকা, অন্যদিকে আরো সাড়ে তিন দিন ব্যাটিং চালিয়ে যাওয়া পাকিস্তান দলের জন্য অসম্ভব ছিল! ২৩ বছর বয়সী হানিফ মোহাম্মদ সঙ্গী ইমতিয়াজ আহমেদকে (উইকেট কিপার) নিয়ে ব্যাট করতে নামেন। দিনের শেষ দিকে ইমতিয়াজ ৯১ রান করে এলবিডাবলিউ হন। পাকিস্তান ১৬২ রান করে দিন শেষ করে। তখন হানিফ মোহাম্মদের রান ৬১। এ সময় আরেক ব্যাটসম্যান আলিম উদ্দিন এসে হানিফের সঙ্গে যোগ দেন।
তৃতীয় দিনের খেলা যখন শুরু হয় তখন প্রচ- গরম। অন্যদিকে চলে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বোলারদের নানানমুখী কৌশল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলার অ্যাটকিনসন মাথায় অতিরিক্ত ক্রিম দিয়ে মাঠে নামতেন। ওই ক্রিম বলে ঘষে এমন অবস্থা করতেন যাতে বল দু’দিক থেকেই সুইং করে। এতো কিছুর পরও হানিফ তার আস্থায় অবিচল। কেননা তার অধিনায়ক হাফিজ কারদার মাঠে নামার সময় বলে দিয়েছেন, ‘তুমিই আমাদের একমাত্র ভরসা।’ এদিকে আলিম উদ্দিন আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের মাধ্যমে হানিফের সঙ্গ ভালোভাবেই দিচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি ৩৭ রান করে আলেকজান্ডারের বলে সোবার্স-এর হাতে ধরা পড়েন। দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে রানের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১১২। তখন দলীয় রান ২৬৪। এরপর সদ্য ডেবু হওয়া সাইদ আহমেদ ব্যাট করতে আসেন। হানিফ মোহাম্মদ তখন পাকিস্তান দলের অতন্দ্র প্রহরী। চতুর্থ দিন শেষে পাকিস্তানের সংগ্রহ দুই উইকেটে ৩৩৯ এবং হানিফের রান অপরাজিত ১৬১। বিকালে হানিফের পিঠ চাপড়ে অধিনায়ক হাফিজ কারদার বলেন, ‘তুমিই পারবে!’ তখনো খেলার দু’দিন বাকি। এরই মধ্যে সাইদ আহমেদ ব্যক্তিগত ৬৫ রান করে কট আউট হন। তখন দলের রান ৪১৮। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বোলারদের সব কৌশল তোয়াক্কা না করে হানিফ কখনো ধীরস্থির, কখনো আক্রমণাত্মক খেলা খেলে এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে। সাইদ আউট হওয়ার পর হানিফের সঙ্গে যোগ দেন তারই বড় ভাই ওয়াজির মোহাম্মদ। দিন শেষে পাকিস্তানের রান তিন উইকেটে ৫২৫ এবং হানিফের অপরাজিত ২৭০।
তখনো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৫২ রানের লিডে। পাকিস্তানের একটা আকস্মিক ধস ওয়েস্ট ইন্ডিজকে জিতিয়ে দিতে পারে। আবারও হানিফের প্রতি অধিনায়ক কারদার-এর নির্দেশনাÑ ‘তুমি যদি আগামীকাল টি ব্রেক পর্যন্ত খেলে যেতে পারো তাহলে ম্যাচটা ড্র করা যাবে!’ হানিফ ইতোমধ্যে আড়াই দিন ব্যাট করে ফেলেছেন। কিংসটন ওভালের গ্যালারি ও স্টেডিয়ামের আশপাশের গাছে বসে যারা খেলা দেখছিলেন তারা চিৎকার করে হানিফ মোহাম্মদকে উৎসাহ জোগাচ্ছিলেন। এমনকি দর্শকের মধ্যে কেউ কেউ চিৎকার করে অ্যাটকিনসন-এর বল কীভাবে খেলতে হবে ওই পরামর্শও দিচ্ছিলেন হানিফকে। এরই মধ্যে তার বড় ভাই ওয়াজির মোহাম্মদ ৩৫ রান করে আউট হয়ে গেলেন। সেদিন লাঞ্চ ব্রেক পর্যন্ত হানিফ ১৪ ঘণ্টা ১৮ মিনিট ব্যাট করে ৩৩৪ রান স্পর্শ করেন। অধিনায়ক হাফিজ কারদার ব্যাটিংয়ে এলেন। হানিফ ইতোমধ্যেই অধিনায়কের ইচ্ছা পূরণ করে ফেলেছেন। তার ব্যক্তিগত ৩৩৪ রানের পাশাপাশি দলের সংগ্রহ তখন পাঁচ উইকেটে ৬২৩। ম্যাচ নিশ্চিত ড্রয়ের পথে। ব্যক্তিগত রান যখন ৩৩৭ তখন অ্যাটকিনসনের বলে আলেকজান্ডারের হাতে ধরা পড়েন হানিফ। ততোক্ষণে ইতিহাস তৈরি হয়ে গেছে। ৯৭০ মিনিটের অবিচল ব্যাটিং যা এর আগে ইংল্যান্ডের লেন হাটন-এর ৭৯৭ মিনিটের রেকর্ড ছাড়িয়ে অনেক দূর। দীর্ঘ সময় প্রচ- গরমে ব্যাটিং করতে গিয়ে হানিফের চোখের পাতার তিন পরত চামড়া খসে গেছে। ওই ৩৩৭ রানের মধ্যে ২৪টি বাউন্ডারি, ১৬টি তিন, ৪৪টি দুই ও ১০৫টি একক রানের সংগ্রহ রয়েছে। সবচেয়ে অবাক কা- হচ্ছে, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বোলাররা শত চেষ্টা করেও হানিফের প্যাডে একটি বলও লাগাতে পারেননি। পারলে ফল অন্য রকম হতে পারতো। কেননা ওই সময় ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান অ্যাম্পায়ারদের এ বিষয়ে সুখ্যাতি ছিল। হানিফ আউট হওয়ার পর ফজল মাহমুদ এসে কয়েকটা ছক্কা পিটিয়ে দলের রান ৬৫৭-তে নিয়ে গেলেন। হাফিজ কারদার ইনিংস ডিক্লেয়ার করলেন। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওপেনিং ব্যাটসমানরা কয়েক মিনিট ব্যাট করার পর শ্বাসরুদ্ধকর ওই খেলা ড্র দিয়ে শেষ হয়।
হানিফ মোহাম্মদের ওই অবিস্মরণীয় অবিচল ব্যাটিং বিশ্ব ক্রিকেট ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচনা করলো। ছোটখাটো গড়নের হানিফ মোহাম্মদকে লিটল মাস্টার বলা হতো এবং তিনিই অরিজিনাল লিটল মাস্টার।
এখানেই শেষ নয়। ১৯৫৯ সালের ৮ জানুয়ারি করাচি স্টেডিয়ামে ভাওয়ালপুরের বিরুদ্ধে করাচি দলের হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে হানিফ ৪৯৯ রান করেন। তা এর আগে ডন ব্রাডমান-এর করা ৪৫২ রান ছাড়িয়ে যায়। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর্যন্ত ওই রেকর্ড অম্লান ছিল। ক্রিকেটের আরেক কিংবদন্তি ব্রায়ান লারা ১৯৯৪ সালে ওয়ারউইকশায়ার-এর পক্ষে ৫০১ রান করে ওই রেকর্ড ভঙ্গ করেন।
হানিফের বাবা ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর সৈনিক। জুনাগড়ে তাদের অনেক সম্পত্তি ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হওয়ার পর তারা শূন্য হাতে পাকিস্তান চলে আসেন। এমনকি রিফিউজি হিসেবে তাদের ঠাঁই হয়েছিল করাচির এক হিন্দু মন্দিরে। তার মা আমির বাঈ ছিলেন ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়। তিনি ব্যাডমিন্টন খেলে অনেক পুরস্কারও জিতেছিলেন। প্রতিবারই পুরস্কার নিয়ে ঘরে ফেরার পর ছেলেদের বলতেন, ‘তোমাদেরও ক্রিকেট খেলে এভাবে পুরস্কার জিতে আনতে হবে।’ প্রায় সব ভাই-ই মায়ের স্বপ্ন পূরণ করেছিলেন। তাদের মধ্যে হানিফ মোহাম্মদ যে পুরস্কারটি অর্জন করেন, তা ক্রিকেটের ইতিহাসে সব সময় উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হয়ে থাকবে।
‘হানিফ এই গ্রহে পরিপূর্ণ ক্রিকেটার হিসেবেই এসেছেন। আমি ওই বালককে কোচিং দিতে চাই না। প্রকৃতিগতভাবে তার সবকিছুই আছে। ক্ষুদ্রাকার ওই বালকের স্বচ্ছন্দ ব্যাটিং, টেকনিকের দক্ষতা আমাকে ব্রাডম্যান-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। তার কোচিংয়ের প্রয়োজন নেই। তাকে তার স্বাভাবিক খেলা খেলতে দিলেই সে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানে রূপান্তর হবে’Ñ হানিফের খেলা দেখে ১৯৫১ সালে ইংল্যান্ডের কোচ অ্যালফ গোভার এ মন্তব্য করেন।