জীবন ও পতনের গল্প
সিনেমার কাহিনীতে দেখা যায়, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে মিঠু। চাকরি খোঁজে এখানে সেখানে। বিভিন্ন কোম্পানীর অফিসে সিভি জমা দেয় কিন্তু তার মতো হাবা টাইপের ছেলেকে কেউই পাত্তা দেয় না। কেউ সিভি গ্রহণ করলেও পরক্ষণে তা ফেলে দেয়। এভাবেই চলতে থাকে তার চেষ্টা। ঘটনাচক্রে এক ব্যক্তির মাধ্যমে সে যুক্ত হয় ‘মাল্টি লেবেল মার্কেটিং’ বা এমএলএম ব্যবসার সঙ্গে। সেখান থেকে তাকে হাজারো রঙিন স্বপ্ন দেখানো হয়। একদিন সে অনেক টাকার মালিক হয়ে যাবে, বাড়ী, গাড়ি কোন কিছুরই তার অভাব থাকবে না। এই ভেবে সে শুধু স্বপ্ন দেখতেই থাকে। একদিন চোরাই মোবাইল কিনতে গিয়ে জনপ্রিয় নায়িকা রিমার একটি মোবাইল তার হাতে আসে। মোবাইলটিতে নায়িকা রিমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে একটি প্রাইভেট ভিডিও ক্লিপ ছিল। ভিডিও ক্লিপটিতে নায়িকা রিমা ও তার বয়ফ্রেন্ডের ব্যক্তিগত ও অন্তরঙ্গ কিছু সময় ভিডিওতে ধারণ করা আছে। যা কোনভাবে কারও হাতে গেলে ফেসবুক, ইউটিউব এসকল স্যোসাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে পারে, এতে রিমার ইমেজ ও ক্যারিয়ারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, সেই আতঙ্কে থাকে রিমা। মিঠু সেই সুযোগটি কাজে লাগায়। শুরু হয় রিমার জীবনে নতুন উপদ্রব। একপর্যায়ে একদিন ‘সিনেমাতে স্বামী-স্ত্রী যেভাবে মেলামেশা করে, একজন আরেকজনকে ভালোবাসে, মিঠু এই রকম একটা প্রস্তাব রিমাকে দিয়ে বসে। মিঠুর এই জাতীয় প্রস্তাবে রিমা আকাশ থেকে পড়ে। মিঠু রিমাকে ভিডিওটির কপি আছে বলে ভয় দেখায়। রিমা তার কথায় বাধ্য হয়ে অনেক কিছুই করে কিন্তু সব করতে সে রাজি হয় না। মিঠুকে একপর্যায়ে রিমা চড় মারে, তার অমানবিক আচরণের জন্য। মিঠু অমানবিক হয়ে ওঠে। অনেকটাই ‘সাইকো’! সে শুধু রিমা নয়, টাকা নেয় বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে। হঠাৎ পত্র-পত্রিকায় এমএল এম নিয়ে নেতিবাচক লেখালেখি, তদন্ত এসবের কারণে এই বাণিজ্য বন্ধ হয়ে পড়ে। পাওনাদারেরা টাকার জন্য তাগাদা দেয় মিঠুকে। তার বাড়িতে এসে খোঁজে। মিঠু বাড়িছাড়া, ঘরছাড়া। পালিয়ে বেড়ায়। যখন তাকে বাড়িতে দেখা যায়, তখন সে অনেকটাই অপ্রকৃতিস্থ। এদিকে রিমা ও তার ভিডিও ক্লিপটি ফাঁস হওয়ার আতঙ্কে ভয়ে থাকে। এভাবেই এগিয়ে যায় পরবর্তী কাহিনী।
পিঁপড়াবিদ্যা জীবন ও পতনের গল্প। ইঙ্গিত প্রতীকী দৃশ্যে এই সময়ের বাংলাদেশকেই তুলে ধরে। পরিচালক ইঙ্গিত করেছেন অনেক কিছুই, যা সমকালীন নানা বাস্তবতার ওপর ফোকাস করে। এমএলএম কর্মকর্তার দারিদ্র্য জাদুঘর তত্ত্ব, সেক্স ভিডিও ক্লিপ
ইত্যাদি। রিমার বাড়িতে খাবার টেবিলে মিঠুর পানি খাওয়ার দৃশ্যটিতে অবদমিত কাম স্পষ্ট
ফুটে ওঠে। চাবি দেওয়া পুতুলটির মাথা নেড়ে অনিচ্ছা ও অনৈতিকতার কথা মনে করিয়ে
দেয়। মিঠুর তিনবার মুখ ধোয়াও সিগনিফিকেন্ট। অসংখ্য পিঁপড়া মিঠুর মুখে কিংবা পিঁপড়া নেই অথচ মেঝেতে পিঁপড়া মারতে চাওয়া লোভের জালে আটকে যাওয়ারই ইঙ্গিত। ম্যানিকুইনের সঙ্গে মিঠুর রাত্রিবাস,
সেলফোন কোম্পানি, করপোরেট পলিটিক্স বাদ যায়নি, মিঠুর বান্ধবীর স্বামী চরিত্রের মধ্য দিয়ে। তার চরিত্রটি বোকা ও ডেমো মনে হলেও, দুর্নীতির নানা চিত্র ফাঁস হয় কল্পিত বর্ণনায়।
লংশট, মিডশট, ক্লোজশট, ব্যাকরণ আর সময়কালের ব্যাপ্তি কখনও ছবির একমাত্র শর্ত হতে পারে না। ভালো ছবির তো অবশ্যই না। ছবি যদি সময়কে ধারণ করে, জীবন যদি উপজীব্য হয়, দর্শক যদি নিজের বা অন্যের জীবনকে মেলাতে পারে ছবির সঙ্গে, তবে তাই ছবি। মনে রাখতে হবে, ছবি জীবনের অনুকরণ। ইমিটেশন অব লাইফ। সরাসরি সম্প্রচার বা লাইভ ব্রডকাস্ট আর যাই হোক, তাকে চলচ্চিত্র বলা যায় না।
বাংলাদেশে গত কয়েক দশক থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে আসছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। একে একে নির্মাণ করেছেন ব্যচেলর, মেইড ইন বাংলাদেশ, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, টেলিভিশন ও সর্বশেষ সম্প্রতি মুক্তি পায় ‘পিঁপড়া বিদ্যা’। তার চলচিত্রের গল্প বলার ঢং সব সময়ই একটু আলাদা গৎবাধাঁ নির্মাণ নিয়মের বাইরে। সমাজে গঠিত অনেক কিছুই ঘটে যা কিনা, সেখানে যেমন উঠে আসে পরিবার, মহল্লা, প্রেম, যৌনতা, হটকারিতা, রাজনীতি আরও নানান বিষয়। ‘টেলিভিশন’ ছাড়া তার পূর্বের প্রায় সকল পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে নাগরিক জীবনের নানান অলিগলি ফোকাস হলেও এই চলচ্চিত্রে মধ্যবিত্ত এক তরুণের গল্প, মিডিয়া, মাল্টিলেবেল মার্কেটিং বিষয়গুলোকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
লেখা : দিগন্ত সৌরভ
ছবি : গোলাম মাওলা নবীর ও আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির